খেলাধুলায় অংশগ্রহণ মানেই শরীরের উপর বাড়তি চাপ। অ্যাথলেটদের জন্য ইনজুরি যেন খেলাধুলারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৩০–৪০ শতাংশ খেলোয়াড় কোনো না কোনো ধরণের ইনজুরিতে ভোগেন। বিশেষ করে ফুটবল,ক্রিকেট, রাগবি বা হকির মতো খেলায়। ইনজুরির পর দ্রুত পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপি অপরিহার্য। গবেষণা বলছে, মোট ইনজুরিগ্রস্ত খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রায় ৭০–৯০ শতাংশই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নেন। এটি শুধু ব্যথা কমায় না, বরং শরীরের স্বাভাবিক মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনে এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের ইনজুরি প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। সংখ্যায় যদি প্রকাশ করা যায়, তবে দেখা যায় প্রতি ১০ জন ইনজুরিগ্রস্ত খেলোয়াড়ের মধ্যে ৭–৯ জন ফিজিওথেরাপি গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়। বাকি ক’জন কেবল বিশ্রাম, ওষুধ বা গুরুতর অবস্থায় অস্ত্রোপচারের ওপর নির্ভর করেন। খেলাধুলায় ফিজিওথেরাপির শিকড় প্রাচীন সভ্যতায়। গ্রীস ও রোমের যুগে ক্রীড়াবিদদের সুস্থ রাখার জন্য বিভিন্ন থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ ব্যবহার করা হতো। এমনকি রোমান গ্ল্যাডিয়েটররাও দ্রুত মাঠে ফেরার জন্য এ ধরনের থেরাপি পেতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাধুলার ব্যাপক প্রসার ঘটে। অলিম্পিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার কারণে খেলোয়াড়দের সুস্থ রাখা ও দ্রুত পুনর্বাসন জরুরি হয়ে ওঠে। এ সময় থেকে ফিজিওথেরাপি ধীরে ধীরে খেলাধুলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত হয়। ইলেক্ট্রোথেরাপি, হাইড্রোথেরাপি ও থেরাপিউটিক এক্সারসাইজভিত্তিক চিকিৎসা জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৬০–৭০-এর দশকে খেলাধুলার ফিজিওথেরাপি একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পেশাদার ক্লাব ও অলিম্পিক দলগুলো স্থায়ীভাবে ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ শুরু করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে International Federation of Sports Physical Therapy (IFSPT) গঠনের মাধ্যমে এই শাখার বৈজ্ঞানিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হয়। ২১শ শতকে খেলাধুলার ফিজিওথেরাপি আর শুধু আঘাত সারানো নয়, বরং পারফরম্যান্স উন্নয়ন ও আঘাত প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেমন মোশন অ্যানালাইসিস, শকওয়েভ থেরাপি, ক্রায়োথেরাপি ইত্যাদি। পাশাপাশি গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসা, বহুমুখী বিশেষজ্ঞ দলের সহযোগিতা এবং ক্রীড়াবিদদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নও এ ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
পেশাদার হোক বা শৌখিন, খেলোয়াড়দের শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, ফলে তারা সহজেই মচকানো, পেশি টান, জয়েন্টে আঘাত কিংবা হাড় ভাঙার মতো সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি তাদের দ্রুত ও নিরাপদভাবে সুস্থ হতে সাহায্য করে। নিয়মিত ওয়ার্ম-আপ, স্ট্রেচিং, স্ট্রেনথেনিং এক্সারসাইজ এবং শরীরের পোশ্চার সংশোধনের মাধ্যমে ফিজিওথেরাপিস্টরা খেলোয়াড়দের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সাহায্য করেন। তবুও যদি আঘাত লাগে, তবে ম্যানুয়াল থেরাপি, ইলেকট্রোথেরাপি, থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ, পুনর্বাসন ও টেপিং-এর মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ফিজিওথেরাপিস্টরা খেলোয়াড়দের কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনেন। এছাড়াও পারা-অ্যাথলেটদের জন্য স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি শুধু ইনজুরি সারানোর বিষয় নয়, হুইলচেয়ার স্পোর্টসে কাঁধে চাপ, প্রস্থেটিক ব্যবহারে ব্যথা, বা ওভারইউজ ইনজুরি—এসব ক্ষেত্রে স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি কার্যকর সমাধান দেয়। ম্যানুয়াল থেরাপি, ইলেক্ট্রোথেরাপি ও স্পোর্টস-নির্দিষ্ট ব্যায়ামের মাধ্যমে তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে খেলায় ফেরে। বিশ্বজুড়ে এখন প্যারা-স্পোর্টস জনপ্রিয় হচ্ছে, তাই স্পোর্টস ফিজিওথেরাপির চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। সঠিক ফিজিওথেরাপি থাকলে প্যারা-অ্যাথলেটরা শুধু প্রতিযোগিতায়ই সফল হয় না, বরং রেকর্ড গড়ছে এবং প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছে।
আজকের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার যুগে, যেখানে একটি ছোট আঘাতও ক্যারিয়ারকে থামিয়ে দিতে পারে, সেখানে ক্রীড়া ফিজিওথেরাপি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এটি শুধু আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়দের জন্য নয়, বরং শিক্ষার্থী, ফিটনেস অনুরাগী এবং সাধারণ মানুষকেও সমানভাবে উপকৃত করে। নিরাপদভাবে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং দ্রুত সেরে ওঠার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি সুস্থ শরীর ও মনের জন্য অমূল্য অবদান রাখছে।
এছাড়া, কোনো খেলোয়াড়ের অস্ত্রোপচারের পর মাঠে ফেরার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন প্রয়োজন হয়। স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্টরা এ সময়ে স্ট্রেনথ, ব্যালেন্স ও সহনশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেন। শুধু আঘাত নিরাময় নয়, বারবার একই সমস্যা এড়াতে শরীরের ভেতরে থাকা মূল কারণগুলিও তারা সমাধান করেন।
ডা: নাজমুল আলম নিরব, পিটি
ফিজিওথেরাপিষ্ট
"ফেডারেশন অব স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি বাংলাদেশ "